মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার গুঞ্জন তাঁর ক্যারিয়ারে অনেকবারই শোনা গেছে। কিন্তু এবারের মতো সেটির সত্যি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্ভবত এত বেশি কখনো ছিল না।
নতুন খবর, কোম্যানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে মেসি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর বার্সেলোনায় থাকার চেয়ে বার্সেলোনা ছাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা মেসির দলবদল নিয়ে গুঞ্জন তো প্রতিদিনই অনেক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বোমাটা ফাটিয়েছে ফুটবলবিষয়ক ব্লগ ইএসপিএন। স্প্যানিশ ফুটবল নিয়ে কাজ করা তাদের দুই বিখ্যাত সাংবাদিক মোইজেস ইয়োরেনস ও স্যাম মারসডেনের প্রতিবেদন, বার্সেলোনার বোর্ডেরই কেউ কেউ চাইছেন, মেসি চলে যান!
নতুন কোচ রোনাল্ড কোম্যান এসেই বললেন, লিওনেল মেসিকে ঘিরেই দলটা গড়তে চান। বার্সেলোনার নতুন ক্রীড়া পরিচালক রামন প্লানেসও বলে দিয়েছেন, ‘নতুন বার্সেলোনা’কে তাঁরা গড়তে চান তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় দিয়ে, যাদের নেতৃত্বে থাকবেন মেসি। কিন্তু সেই মেসিরই যে বার্সেলোনায় থাকা সংশয়ে।
বার্সেলোনা কেন ছাড়তে চান মেসি, তা পরিষ্কার। ক্লাবের বোর্ডের একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্তে বার্সেলোনা মাঠে-মাঠের বাইরে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। দলের প্রয়োজন না বুঝে তারকার পেছনে ছুটে একের পর এক ব্যর্থ দলবদলের গল্প উপহার দিয়েছে জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর বোর্ড। ক্লাবের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। মাঠে দলের পারফরম্যান্সে এক মেসিকে বাদ দিলে ইউরোপের মাঝারি সারির দলই মনে হয় এখন বার্সাকে। না খেলায় সৌন্দর্য আছে, না আছে বড় কোনো দলের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো ক্ষমতা। রক্ষণ-মাঝমাঠ বলে যেন কিছু নেই! এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে যে ৮-২ গোলে হারের অপমান নিয়ে বাড়ি ফিরেছে বার্সা, তা গত কয়েক মৌসুমে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তেরই ফসল বটে।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের গুঞ্জন, বার্সেলোনাকে এখনো আগের মতোই ভালোবাসেন মেসি। যে ক্লাব তাঁকে ছোট থেকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, সেই ক্লাবের প্রতি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের ভালোবাসায় কোনো খুঁত নেই। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে এমন গড়পড়তা একটা দল নিয়ে হতাশ, বোর্ডের ওপর তিতিবিরক্ত।
ক্লাব সভাপতি বার্তোমেউর বিরুদ্ধে মেসিসহ ক্লাবের অনেক কিংবদন্তির বিরুদ্ধে অনলাইনে কুৎসা রটানোর অভিযোগ উঠেছে। গত জানুয়ারিতে সাবেক কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দেকে বরখাস্ত করার নেপথ্যে খেলোয়াড়দের ভূমিকা জানিয়ে ক্লাবের সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া ক্রীড়া পরিচালক এরিক আবিদালের বিবৃতি, করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার শুরুর দিকে খেলোয়াড়েরা বোর্ডের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বেতন কমালেও তার আগে খেলোয়াড়দের বেতন কমানো নিয়ে বোর্ডের অনেকের উল্টোপাল্টা বিবৃতি…এসব নিয়ে মেসি কড়া জবাব দিয়েছিলেন। আর মাঠে—বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে—টানা কয়েক বছরের হতাশা তো আছেই। ২০০৭-০৮ মৌসুমের পর এবারই প্রথম মৌসুমে শিরোপাশূন্য বার্সা। এই বোর্ড বার্সেলোনাকে শিরোপা জেতানোর মতো দল গড়ে দিতে পারবে, সেই বিশ্বাস দৃশ্যত আর নেই মেসির।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি মেসি ক্লাব ছাড়ার ব্যাপারেই মনস্থির করেন, বোর্ড কী করবে? ইএসপিএন জানাচ্ছে, বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য যেকোনো মূল্যে ক্লাবের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়কে ধরে রাখারই পক্ষে। তবে দু-একজনের ভিন্নমতও আছে। ইএসপিএনকে অল্প কয়েকজন বোর্ড পরিচালক বলেছেন, মেসির জন্য ভালো কোনো প্রস্তাব এলে তাঁরা সেটি বিবেচনা করে দেখারই পক্ষে। সে ক্ষেত্রে মেসিকে বিক্রি করে পাওয়া অর্থে অন্য খেলোয়াড় কেনার সুযোগ পাবে বার্সেলোনা, মেসির বড় অঙ্কের বেতনের চাপটাও কমবে।

ইএসপিএন ক্লাবের অনেক সূত্রের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছে। তাঁদের বেশির ভাগই মেসির দলবদলের গুঞ্জন নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা করছেন না। কারণ, আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের চুক্তিতে এখনো ১ বছর বাকি। আর এই সময়ে বার্সেলোনার ইচ্ছার বাইরে তাঁকে কিনতে গেলে কোনো ক্লাবকে রিলিজ ক্লজের ৭০ কোটি ইউরো দিতে হবে! ৩৩ বছর বয়সী একজনের জন্য এত দাম নিশ্চয়ই কোনো ক্লাব দেবে না। যেখানে দলবদলের বাজারে বর্তমান বিশ্ব রেকর্ড ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরোর—২০১৭ সালে বার্সা থেকে নেইমারকে কেনার সময় যে অর্থ খরচ করেছিল পিএসজি। যদিও ২০১৮ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যাওয়ার ব্যাপারটা এখানে আলোচনায় আসতে পারে। পর্তুগিজ মহাতারকার চুক্তিতে রিলিজ ক্লজ ১০০ কোটি ইউরো থাকলেও রিয়ালকে রাজি করিয়ে তাঁকে ১০ কোটি ইউরোতেই কিনেছে জুভেন্টাস।
মেসি ক্লাব ছাড়বেন না—এই বিশ্বাসের নেপথ্যে বার্সা বোর্ডের বেশির ভাগেরই আরেকটা ধারণা কাজ করছে। সেটি এই—নতুন কোচ কোম্যান দল নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মেসিকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ক্লাবে থেকে যেতে রাজি করাতে পারবেন।
ভিন্ন মতও আছে। ইএসপিএন লিখেছে, ক্লাবের উচ্চপদে থাকা অন্তত একজন জানিয়েছেন, মেসি যদি খুশি না থাকে, সে ক্ষেত্রে বার্সেলোনার উচিত বড় অঙ্কের প্রস্তাব পেলে তাঁকে যেতে দেওয়া। ক্লাব সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ অবশ্য মেসিকে ক্লাবে রাখতে বদ্ধপরিকর। আগামী মৌসুমেই শেষ হতে যাওয়া তাঁর চুক্তি অন্তত আরও দুবছর বাড়িয়েও নিতে চান। তাঁর সভাপতিত্বের সময়েই ক্লাবের—তর্কসাপেক্ষে সময়ের ও ফুটবল ইতিহাসেরই—সেরা ফুটবলার বার্সেলোনা ছেড়ে গেছেন, এমন পরিচয়ে পরিচিত থাকতে চান না বার্তোমেউ।
তবে মেসির চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনা আপাতত একেবারেই থেমে আছে। বার্সেলোনা চাইছে, বায়ার্নের কাছে অপমানের পর মেসি যে রেগেছেন, সেই রাগটা কমে যাক। তারপর না হয় সুবিধাজনক সময়ে চুক্তির আলোচনা তুলবে বার্সা। যদি তত দিন মেসি বার্সায় থাকেন আর কী!

